একটি গল্প দিয়ে শুরু করা যাক। হাসান সাহেব, একজন অবসরপ্রাপ্ত কলেজ শিক্ষক। তিনি তার সারাজীবনের সঞ্চিত অর্থ দিয়ে কেনা এক খন্ড জমির উপর অবশেষে বাড়ি নির্মান করতে যাচ্ছেন। বাড়ির নকশা কিংবা আনুসাঙ্গিক নিয়ে উনার তেমন কোনো ধারণা নেই বললেই চলে। অজ্ঞতার কারনে হোক বা যে কারনেই হোক না কেন কোন ধরনের ক্যালকুলেশন না করে, নিয়ম না মেনেই বাড়ি তৈরি করলেন অদক্ষ ডেভেলোপার কোম্পানিকে দিয়ে। ফলে দেখা গেল বাড়িটি নিয়ে বিভিন্ন সমস্যার সম্মুখিন হচ্ছেন।
তাই নিজের স্বপ্নের বাড়ি তৈরি করতে গেলে মানতে হবে বেশ কিছু নিয়ম, কিছু বিষয় আনতে হবে হিসাব- নিকাশের আওতায়। আপনার জমি ৫ কাঠা, ১০ কাঠা যেটাই হোক না কেন আপনি কখনই পুরোটার উপর আপনার বাড়ি তুলতে পারবেন না, আপনাকে আশেপাশে ছেড়ে দিতে হবে বেশ কিছু জায়গা। কতটুকু স্থান আপনাকে ছাড় দিতে হবে তার হিসাব পাবেন ফ্লোর-এরিয়া রেশিও ক্যালকুলেশন (FAR Calculation) বা ফার ক্যালকুলেশন এর মাধ্যমে। চলুন তাহলে জেনে নেয়া যাক ফার ক্যালকুলেশন সম্পর্কে বিস্তারিত।
ফ্লোর-এরিয়া রেশিও ক্যালকুলেশন হচ্ছে একটি জমির ক্ষেত্রফলের অনুপাত অনুযায়ী বাড়ির সন্নিবেশযোগ্য সম্পূর্ণ মেঝের ক্ষেত্রফল, অর্থাৎ একটি প্লটের মাঝে যে বাড়িটি তৈরি হবে তার পুরো ফ্লোর এরিয়ার যোগফলকে উক্ত প্লটের বিদ্যমান জমির ক্ষেত্রফল দ্বারা বিভাজনের ফল। আরও সহজ করে বলা যায় এটি প্রধান বাল্ক রেগুলেশন ক্যাল্কুলেশন যা বিল্ডিংয়ের আকার নিয়ন্ত্রণ করে। যেমনঃ একটি একতলা বিল্ডিং লটের ১০০% জায়গা জুড়ে, দুই তলা ৫০% এবং চারতলা ২৫% কভার করে।
ফার ক্যালকুলেশনের সূত্রটি হচ্ছে,
ফার= সকল মেঝের সম্মিলিত ক্ষেত্রফল/ জমির ক্ষেত্রফল অর্থাৎ ,
FAR = Total floor area / Land area
রোডের প্রস্থের সাথে ফার ক্যালকুলেশনের একটি সম্পর্ক রয়েছে। দালান নির্মানের সময় সামনে, পেছনে এবং দুই পাশে রাস্তা থাকে, ফলে বেশকিছু জায়গা ছেড়ে দিতে হয়। কতটুক জায়গা ছাড় দিতে হবে টা জানা যায় সেটব্যাক (Setback) নিয়মের মাধ্যমে। ফ্লোর এরিয়া ও ফ্লোর সংখ্যা নির্ভর করে জমির পরিমাণ ও রাস্তার প্রস্থের উপর।
রাজউকের ২০০৮ সালে ইমারত নির্মাণ বিধিমালায় লেখা আছে ইমারত নির্মাণের সময় প্লটের আকারভেদে ৩৫ থেকে ৫০ ভাগ জমি ছেড়ে ভবন নির্মাণ করতে হবে এবং সেই অনুপাতে উপরের দিকে ভবনের উচ্চতা বাড়ানো যাবে। এখন জেনে নেওয়া যাক রাজউকের নিয়ম অনুযায়ী ফ্লোর-এরিয়া রেশিও ক্যালকুলেশন বের করার উপায়।
ধরা যাক একটি প্লটের আকার ৬ কাঠা। সেটব্যাক নিয়ম অনুযায়ী, একটি আবাসিক ভবনের জন্য, রাস্তার প্রস্থ অবশ্যই ৬ মিটার হতে হবে।
এখন, যদি ফার = ৩.৭৫; MGC = ৬০.০০% (চার্ট অনুযায়ী)
ম্যাক্সিমাম ফ্লোর এরিয়া (MBA) = (৬× ৭২০)×৩.৭৫ = ৪৩২০×৩.৫ = ১৬২০০ বর্গ ফুট
অতএব, সেটব্যাক নিয়ম অনুযায়ী ছেড়ে দিতে হবে (MGC) = ৪৩২০× ৬০/ ১০০ = ২৫৯২ বর্গ ফুট
বিল্ডিং এর তালার সংখ্যা= MBA /MGC= ১৬২০০/২৫৯২= ৬.৩
বিল্ডিং এর মোট তালার সংখ্যা= ৬.৩+ ১ (গ্রাউন্ড ফ্লোর) = ৭.৩ (.৩ হল এক্সটেনশন)
এখানে, FAR = Total floor area / Land area= ১৬২০০/৪৩২০= ৩.৭৫
কমার্শিয়াল প্লট হচ্ছে যেখানে বাসাবাড়ি ব্যতিত রেস্টুরেন্ট, হোটেল, ফ্যাক্টরি ও শপিং মল নির্মান করা হয়। এখানেও ফার ক্যাল্কুলেশনের জন্য একি নিয়ম হলেও উপরের চিত্র লক্ষ্য করলে দেখবেন যে FAR ও MGC এর মানের সাথে একি পরিমান জমির উপর বাড়ির FAR ও MGC এর মানের সাথে ভিন্নতা রয়েছে। তাই অন্যান্য মানেও সামান্য ভিন্নতা আসবে।
ফার ক্যালকুলেশনের পূর্বে জেনে নেয়া যাক কমন স্পেস ক্যালকুলেশন।
কমন স্পেস হচ্ছে লিফট, লবি,সিঁড়ি ঘর,লিফট মেশিন রুম ,জেনারেটর সাব- স্টেশন,কেয়ারটেকার কক্ষ, গার্ড রুম ,কমন ফ্যাসিলিটিজে যে স্থানগুলো ব্যবহার করা হয়।
আপনার ফ্ল্যাটে কমন স্পেস কতটুকু হবে সেটি কীভাবে বের করবেন টা একটি উদাহরণের মাধ্যমে জেনে নিন।
ধরুন আপনার জমির পরিমাণ ৮ কাঠা, মোট ফ্লোর সংখ্যা ৬ টি
এবং প্রতি ফ্লোরে ইউনিট সংখ্যা ২ টি
অ্যাপার্টমেন্ট সংখ্যা ১২ টি (প্রতি ফ্লোরে ২ টি করে)
প্রতি ফ্লোরে নির্মাণ এরিয়া ২১০০ বর্গ ফুট
প্রতি ফ্ল্যাটে নির্মাণ এরিয়া ১০৫০ বর্গ ফুট
সম্পূর্ণ নির্মাণ এরিয়া ২১০০x৬= ১৩০২০০ বর্গ ফুট
এখন কমন স্পেসের হিসাব করা যাকঃ-
সিড়ি,লিফট ও লিফট লবি =১৬০০ বর্গ ফুট, সাবস্টেশন ও জেনারেটর রুম =৩০০ বর্গ ফুট, ড্রাইভার ওয়েটিং রুম=১০০ বর্গ ফুট, সিকিউরিটি গার্ড রুম= ৮০ বর্গ ফুট, গেস্ট ওয়েটিং রুম=২০০ বর্গ ফুট, কেয়ারটেকার রুম ও রান্নাঘর =১৫০ বর্গ ফুট, গ্রাউন্ড ফ্লোরে ২টি ওয়াশ রুম =৭০ বর্গ ফুট, লিফট মেশিন রুম =১৩৫ বর্গ ফুট, কমিউনিটি রুম এবং ওয়াশ রুম =২০০ বর্গ ফুট
সর্বমোট কমন স্পেস= ২৮৩৫ বর্গ ফুট প্রত্যেক ফ্ল্যাটে কমন স্পেস, ২৮৩৫/১২= ২৩৬ বর্গ ফুট প্রত্যেক ফ্ল্যাটে কার্পেট এরিয়া, ১০৫০-২৩৬=৮১৪ বর্গ ফুট
ওপেন স্পেস হচ্ছে সেই স্পেস যেটুকু অংশ আপনি ফাঁকা রাখবেন। একটি উদাহরণ দিয়ে ব্যাখা করা যাক। ধরুন একটি বিল্ডিং ৩০০০০ বর্গ ফুট এবং এর ওপেন স্পেস রেশিও হচ্ছে বিল্ডিং এরিয়ার ২৫%। তাহলে ওপেন স্পেস যতটুকু দরকার তা হচ্ছে,
Open Space Required = Building Area x OSR = ৩০০০০ x২৫% = ৭৫০০ বর্গ ফুট
২০০৮ বিধিমালা অনুযায়ী, ২ কাঠা বা এর নিচের পরিমাণ জমিতে বাড়ি বা আবাসিক হোটেল নির্মাণে জমি ছাড়তে হয় ৩০ ভাগ। ২ কাঠা থেকে ৩ কাঠা পর্যন্ত জমির ক্ষেত্রে ছাড়তে হয় সাড়ে ৩২ ভাগ, ৩ থেকে ৫ কাঠার ক্ষেত্রে সাড়ে ৩৪ এবং ৫ থেকে ১০ কাঠার ক্ষেত্রে বাড়ি নির্মাণে জমি ছাড়তে হয় সাড়ে ৩৭ ভাগ। এ ছাড়া ৯ থেকে ১২ কাঠার জমির ক্ষেত্রে ছাড়তে হয় সাড়ে ৩৯ ভাগ, ১২ থেকে ১৪ কাঠায় সাড়ে ৪২ ভাগ, ১৪ থেকে ১৮ কাঠায় সাড়ে ৪৪ ভাগ এবং ১৮ কাঠার ওপর জমির ক্ষেত্রে বাড়ি বানাতে চারপাশের জায়গা ছাড়তে হয় সাড়ে ৪৭ ভাগ। রাজউক এটি মনিটর করে থাকে।
যদি আপনার বাড়ি বিমানবন্দরের অথবা সামরিক বাহিনীর আশেপাশের এলাকায় হয়ে থাকে তাহলে আপনাকে অবশ্যই সিভিল এভিয়েশন থেকে ছাড়পত্র সংগ্রহ করতে হবে।
এখন ফ্লোর-এরিয়া রেশিও ক্যালকুলেশনের গুরুত্ব আমরা দুইপাশ থেকে জেনে নিবো। একটি হচ্ছে বাড়ি ক্রয়ের ক্ষেত্রে এবং আরেকটি হচ্ছে ডেভেলপারদের ক্ষেত্রে এর গুরুত্ব।
আপনার বাড়িকে যতটা সম্ভব বসবাসের উপযোগী করে তোলার জন্য ফ্লোর-এরিয়া রেশিও ক্যালকুলেশনের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। ফার ক্যাল্কুলেশনের ফলে , জনসংখ্যার ঘনত্ব, খোলা জায়গার প্রাপ্যতা, প্রকল্পের পরিবেশগত প্রভাব এবং প্রাকৃতিক দুর্যোগের ক্ষেত্রে প্রস্তুতির কথা মাথায় রাখা যায়।
এলাকা বা শহরের ফ্লোর-এরিয়া রেশিও এর উপর ভিত্তি করে ভবনের উচ্চতার অনুমোদন প্রদান করা হয়। ফ্লোর-এরিয়া রেশিও যত বেশি হবে তত বেশি তলা নির্মান করার অনুমোদন পাওয়া যায়।
এটি ফ্লোর-এরিয়া রেশিও সম্পর্কিত সবচেয়ে জনপ্রিয় ভ্রান্ত ধারণাগুলোর মধ্যে একটি। উচ্চ ফ্লোর-এরিয়া রেশিও মান মানে অতিরিক্ত পরিকাঠামোগত খরচ হবে। যাইহোক, সম্পত্তির মূল্যের সাথে এর সরাসরি কোন সম্পর্ক নেই।
যেখানে ফ্লোর-এরিয়া রেশিও অনুপস্থিত সেখানে উন্নয়নমূলক প্রকল্প নির্মাণে কোনো বাঁধা নেই। কারন, ডেভেলপাররা প্রকল্পগুলি নির্মাণের আগে তাদের সামগ্রিক অবস্থা বিবেচনা করে।
আশা করছি আজকের এই লেখার মাধ্যমে আপনারা ফার ক্যালকুলেশন সম্পর্কে একটি পরিষ্কার ধারণা পেয়েছেন। আপনার স্বপ্নের নীড়টি যাতে ঝামেলাহীনভাবে নিজের করে নিতে পারেন সেজন্য আপনার পাশে সবসময় পাবেন ফ্লাগ বাংলাদেশকে (https://www.flagbangladesh.com) । সাথেই থাকুন।