রবীন্দ্রনাথের গানের সুরে চলে এসেছে বাংলা ১৪২৯ সনের প্রথম দিন, পহেলা বৈশাখ। নববর্ষ উৎসব উদযাপন একটি সার্বজনীন বিষয়। বিভিন্ন দেশের, বিভিন্ন সংস্কৃতিতে নববর্ষ উদযাপনের উদাহরণ লক্ষ করা যায়। যেমন- হিজরি নববর্ষ, ইংরেজি নববর্ষ, চীনাদের চন্দ্র নববর্ষ। আবার একই দেশের বিভিন্ন সংস্কৃতিতেও নববর্ষ উদযাপনের ভিন্নতা দেখা যায়। এতে বিভিন্ন সংস্কৃতির বৈচিত্র্য ও স্বকীয়তা ফুটে উঠে। তাদের সংস্কৃতি ও ইতিহাস সম্পর্কে জানার একটা উপলক্ষও তৈরি হয় এতে। তবে বাংলা নববর্ষ উদযাপনকে কেন্দ্র করে এ দেশের হিন্দু-মুসলমানরা বিভিন্নভাবে আয়োজন করে থাকেন। বিশেষ করে দুই বছর যাবত পহেলা বৈশাখ রমজান মাসে হওয়ায় ভিন্ন ধারায় আয়োজিত হচ্ছে। আমরা ইতিহাসের দিকে তাকালে দেখতে পাই, পহেলা বৈশাখের সাথে মুসলমানদের কোনো বিরোধ ছিল না। বরং, মুসলমানদের হাত ধরেই নববর্ষ উদযাপনের ধারণাটা বাংলায় এসেছিল।
আমরা যে ‘সন’ বা ‘তারিখ’ শব্দগুলো ব্যবহার করি, এগুলো মূলত আরবি শব্দ। অন্যদিকে ‘সাল’ হচ্ছে ফারসি ভাষার শব্দ। এতেই বোঝা যায়, আমাদের বছর গণনার ক্ষেত্রে মুসলমানদের সম্পৃক্ততা ভালোভাবেই ছিল। এমনকি পবিত্র কোরআনেও বারো মাসে বছর গণনার উল্লেখ পাওয়া যায়: “আকাশমণ্ডলী ও পৃথিবীর সৃষ্টির দিন হতেই আল্লাহর বিধানে বারোটি মাস নির্ধারণ করেছেন…………” (সূরা তাওবা: আয়াত ৩৬) ইতিহাসের দিকে তাকালে দেখা যায়, বিভিন্ন উল্লেখযোগ্য ঘটনাকে স্মরণ করে বছরকে নির্দেশ করতে। যেমন- সংগ্রামের বছর, যুদ্ধের বছর, বন্যার বছর, করোনার বছর। আবিসিনিয়াতে আবরাহার হস্তিবাহিনী ধ্বংসকে স্মরণ করে চালু হয় হস্তিবর্ষ। হজরত ঈসা(আ.) এর স্মরণে খ্রিস্টাব্দ বা ঈসায়ী সন চালু করা হয়। মহানবী হজরত মুহাম্মদ (সা.) এর হিজরতের বছরকে স্মরণ করে, হজরত ওমর (রা.) হিজরি সন প্রবর্তন করেন। ৬২২ খ্রিস্টাব্দকে প্রথম বছর ধরে তিনি এই হিজরি সন চালু করেন। বাংলায় বিদেশি শক্তি আগমনের আগে থেকেই, এই অঞ্চলের অধিবাসীরা সৌর পঞ্জিকায় বারো মাসে বছর হিসাব করে এসেছেন। তবে এই হিসাবগুলো হতো চান্দ্র-সৌর মিশ্র সনে। অর্থাৎ, মাস গণণা করা হতো চান্দ্র নিয়মে, আর বছর হতো সৌর নিয়মে। ১২০৪ খ্রিস্টাব্দে ইখতিয়ার উদ্দিন মুহাম্মদ বখতিয়ার খিলজি বাংলা বিজয় করেন। এরপর বাংলা অঞ্চলে হিজরি সন রাষ্ট্রীয়ভাবে পালন করা হতে থাকে। তবে এতে চান্দ্র ও সৌরবর্ষের গণনা রীতিতে পার্থক্য থাকায়, কিছু সমস্যা দেখা যায়। পৃথিবী নিজ কক্ষপথে ঘুরতে সময় নেয় ৩৬৫ দিন ৫ ঘণ্টা ৪৮ মিনিট ৪৬ সেকেন্ড। কিন্তু চন্দ্রকাল্র পূরণ হতে লাগে ২৯ দিন ১২ ঘণ্টা, এতে বছর শেষ হতে সময় লাগে ৩৫৪ দিন ৮ ঘণ্টা ৪৮ মিনিট। চান্দ্র মাসের বছরে ১০ থেকে ১১ দিনের তারতম্য দেখা যায়। ফলে তখন বছর হিসাব করতে সমস্যা হওয়ায় কৃষকদের কাছ থেকে খাজনা আদায়েও সমস্যা হতো।
১৫৫৬ সালে মুঘল সম্রাট আকবর ভারতের শাসন ক্ষমতায় আসেন। তার শাসনামলে বছর গণনার ক্ষেত্রে পরিবর্তন আসে। তখন কৃষি ফসল উৎপাদনের সমন্বয় করা ও খাজনা আদায়ের সুবিধার্তে, হিজরি সনের মর্যাদা অক্ষুণ্ণ রেখে বাংলা বর্ষপঞ্জিকা সংস্কারের চিন্তা করা হয়। সম্রাট আকবরের নির্দেশে তার সভার জ্যোতির্বিদ, আমির ফতেহ উল্লাহ খান সিরাজী সৌর বছর ও হিজরি সনকে ভিত্তি করে নতুন বাংলা পঞ্জিকার প্রবর্তন করেন। বাংলা বারো মাসের নাম, বিভিন্ন নক্ষত্রের নাম থেকে নেওয়া হয়। বৈশাখের নাম আসে বিশাখা নক্ষত্র থেকে, জ্যেষ্ঠা নক্ষত্র থেকে আসে জ্যৈষ্ঠ, উত্তর ও পূর্ব আষাঢ়া থেকে আসে আষাঢ়, শ্রবণা নক্ষত্রের নামানুসারে শ্রাবণ, উত্তর ও পূর্ব ভাদ্রপদ নক্ষত্রের নাম থেকে ভাদ্র, অশ্বিনী নক্ষত্র থেকে আশ্বিন, কৃত্তিকা থেকে কার্তিক, মৃগশিরা থেক অগ্রহায়ন (মার্গশীর্ষ), পুষ্যা থেকে পৌষ, মঘা নক্ষত্র থেকে মাঘ, উত্তর ও পূর্ব ফাল্গুনী নক্ষত্র থেকে ফাল্গুন, এবং চিত্রা নক্ষত্র থেকে চৈত্র। এখানে লক্ষণীয়, এসব নাম গ্রহণ করার ক্ষেত্রে হিন্দু ধর্ম বা দেবদেবীর সংস্পর্শতা পাওয়া যায় না। এতে বৈশাখকে বছরের প্রথম মাস হিসাবে গ্রহণ করা হয়। অধিকাংশ পঞ্জিকা বিশারদ মেনে নিয়েছেন, বাংলা সন গণনা শুরু হয়, ১৫৮৪ খ্রিস্টাব্দ থেকে। কিছু ইতিহাসবিদদের মতে, ১৫৮০ খ্রিস্টাব্দে সম্রাট আকবর সব বিরোধী শক্তিকে পরাস্থ করায় জাকজমকভাবে ‘জশনে নওরোজ’ বা নববর্ষ উদযাপন করেন। আকবরের আমলে মাসের প্রতিটি দিনের আলাদা-আলাদা নাম ছিল। রাজ্যের প্রজাদের নাম মনে রাখা কষ্টকর হওয়ায়, সম্রাট শাহজাহানের সময় ইংরেজি সাত দিনের আদলে বাংলায় সাতটি বারের নাম প্রবর্তিত হয়। সম্রাট আকবর বাংলা পঞ্জিকার প্রবর্তক হলেও, বাংলা অঞ্চলে মুঘল সুবেদার ও পরবর্তীতে বাংলার প্রথম নবাব মুর্শিদ কুলি খান এই পঞ্জিকা প্রবর্তন করেছেন বলে মনে করা হয়। একে বলা হতো ‘বাংলা সন’ বা ‘ফসলি সন’।
আমরা দেখতে পাচ্ছি, মূলত কর আদায়ের সুবিধার্তেই মুসলমান শাসকরা বাংলা অঞ্চলে নববর্ষের প্রবর্তন করেন। কিন্তু নববর্ষ কেবল দাপ্তরিক কাজেই সীমাবদ্ধ থাকেনি, পরবর্তীতে এটা রূপ নিয়েছে সামাজিক অনুষ্ঠানে। বাংলা সনের হিসাব অনুযায়ী, চৈত্র্ মাসের শেষ দিনে প্রজাদের সকল খাজনা ও কর পরিশোধ করতে হতো। তারপর বৈশাখের প্রথম দিনে জমিদাররা, নিজ নিজ এলাকার অধিবাসীদের মিষ্টিমুখ করতেন। গ্রামাঞ্চলের ব্যবসায়ীরাও তখন বাকির খাতা হিসাব করার জন্য হালখাতার প্রচলন করেন। বছরের শেষ দিনের মধ্যে ব্যবসায়ী ও দোকানদারদের কাছে বকেয়া আদায় করে পুরোনো খাতার হিসাব চুকিয়ে, বছরের প্রথম দিন নতুন হালখাতার হিসাব শুরু করতেন। ব্যবসায়ীরা হালখাতা শুরুর দিন ক্রেতাদের মিষ্টিমুখ করতেন। বৈশাখ উপলক্ষে গ্রামাঞ্চলে বৈশাখী মেলাও আয়োজন করতে দেখা যেত। এর সাথে শুরু হয় পান্তা-ইলিশ দিয়ে বৈশাখ উদযাপন করা।
পহেলা বৈশাখ একসময় শুধু সামাজিক অনুষ্ঠানে সীমাবদ্ধ থাকলেও ইংরেজ আমল ও পাকিস্তানি আমলে বাঙালির প্রতিবাদ ও স্বকীয়তা প্রকাশের একটা মাধ্যম হয়ে উঠে এই উৎসব। পশ্চিম পাকিস্তানিরা আমাদের সংস্কৃতিকে বিভিন্নভাবে দমন করতে চাইত। তারা রবীন্দ্র সঙ্গীতের মতো বিভিন্ন বাংলা সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডকে নিষিদ্ধ করতে থাকে। ষাটের দশকে পাকিস্তানিদের দমন-নিপীড়নের প্রতিবাদের হাতিয়ার হয়ে উঠে এই পহেলা বৈশাখ।
স্বাধীনতার পরও প্রতিবাদের একটা মাধ্যম হিসাবে ব্যবহার করা হয় পহেলা বৈশাখকে। স্বৈরাচারী এরশাদ বিরোধী আন্দোলনের সময়, আশির দশকে বৈশাখ উদযাপনে নতুন সংযোজন হয় ‘মঙ্গল শোভাযাত্রা’। ১৯৮৯ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা ইন্সটিটিউটের শিক্ষার্থীদের দ্বারা এর কার্যক্রম শুরু হয়। তবে প্রথম দেখা যায় ১৯৮৫ সালে যশোরে, সেখানেও চারুকলার শিক্ষার্থীরাই উদ্যোগ নেন। ২০১৬ সালে, জাতিসংঘের শিক্ষা, বিজ্ঞান ও সাংস্কৃতিক সংগঠন- ইউনেস্কোর স্বীকৃতি পায় মঙ্গল শোভাযাত্রা। এই শোভাযাত্রা নিয়ে বিভিন্ন বিতর্ক থাকলেও এর আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি দেশবাসীর স্বতঃস্ফূর্ত অংশগ্রহণকেই নির্দেশ করে।
গত দুই বছর ধরে পহেলা বৈশাখের তারিখ পড়ছে রমজান মাসে। রমজান মুসলমান ধর্মাবলম্বীদের জন্য পবিত্র একটি মাস। তাদের অনুভূতির প্রতি সম্মান রেখে এবার বৈশাখ উদযাপনেও এসেছে পরিবর্তন। করোনার ধাক্কা সামলে এবারই প্রথম বারের মতো শোভাযাত্রার আয়োজন থাকবে। তবে ধর্মপ্রাণ মুসলমানদের অনুভূতি ও নিরাপত্তার বিষয়কে বিবেচনা করে, ঢাকা মেট্রোপলিটল পুলিশ এই বার দুপুর দুইটার মধ্যে অনুষ্ঠান শেষ করার নির্দেশ দিয়েছে। এতে ঢাকাবাসী সহজেই ইফতারের আগে বাড়িতে পৌঁছাতে পারবে। রোজাদারদের কথা চিন্তা করে কোনো খাবারের দোকান বা উচ্চ শব্দের বাদ্যযন্ত্রও ব্যবহার করতে দেওয়া হবে না। রমজান মাসের ধর্মীয় ভাবধারা বজায় রেখে উৎসব পালনে এগুলো কার্যকরী পদক্ষেপ হিসাবেই ভূমিকা রাখতে পারে।